বিশ্ববাসী কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে তাকিয়ে দেখল-ভুবনমোহন ব্যক্তিত্বের অধিকারী, অনলবর্ষী বাগ্মী, অন্যতম বিশ্বনেতা, নি’র্যাতিত ও মেহনতি মানুষের জন্য নিবেদিতপ্রা’ণ সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হ’ত্যা করা হয়েছে।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঘা’তকরা গোটা স’শস্ত্র বাহিনীকে অ’জ্ঞাত রেখে স’ন্ত্রাসী কর্মকান্ডের মাধ্যমে সুকৌশলে এই ষ’ড়যন্ত্র ও চ’ক্রান্ত বাস্তবায়ন করে। ষ’ড়যন্ত্রকারীদের হোতা ছিল খু’নি জিয়া, খন্দকার মোশতাক, তাহের উদ্দিন ঠাকুর, মাহবুবুল আলম চাষী ও আরও অনেকে।
বঙ্গবন্ধু তাঁর দূরদৃষ্টিতে বুঝেছিলেন, পাকিস্তান রাষ্ট্রে মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে না। একটি অসা’ম্প্রদায়িক, শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই মানুষের মৌলিক অধিকার ও মানবিক মর্যাদা বাস্তবায়ন সম্ভব। আর সেজন্যই তিনি বাংলাদেশকে স্বাধীন করে বাঙালি জনগোষ্ঠীকে মর্যাদাপূর্ণ আসনে বসাতে চেয়েছিলেন। এ লক্ষ্য নিয়েই তিনি প্রথমে ১৯৪৮ সালে ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা করেন। সুসংগঠিত করে গড়ে তোলেন ছাত্রলীগকে।
তিনি সাইকেলে চড়ে ঘুরে ঘুরে গড়ে তোলেন আওয়ামী লীগকে। এ দুটি সংগঠনকে সুদৃঢ়ভাবে গড়ে তোলেন এবং জনমত তৈরি করেন স্বাধীনতার পক্ষে। তার নেতৃত্বে সুদীর্ঘ স্বাধীনতা সংগ্রাম ও সর্বশেষ মুক্তিযু’দ্ধের মাধ্যমে ৩০ লাখ শহীদ ও ২ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে। বঙ্গবন্ধুর এ দীর্ঘ সংগ্রাম ও মুক্তিযু’দ্ধের যারা বি’রোধী ছিল, তারা পাকিস্তানপন্থী রাজাকার, আলবদর এবং তাদের দোসর। তারা কোনোদিনই স্বাধীন বাংলাদেশ মেনে নেয়নি। মুক্তিযু’দ্ধের চেতনা ও আদর্শের ঘোরবি’রোধী ছিল। সেই অপশ’ক্তি বিদেশি শ’ক্তির প্ররোচণা ও ম’দদে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হ’ত্যা করে।
আমাদের মুক্তিযু’দ্ধে বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্র ভারত সর্বতোভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করেছিল। আমাদের ১ কোটি লোককে আশ্রয় দিয়েছিল। দ’খলদার পাকিরা বাংলাদেশে যে গণহ’ত্যা চা’লিয়েছিল, ভারত তার বি’রুদ্ধে বিশ্বব্যাপী জনমত তৈরি করে। ভারত আমাদের দুঃসময়ের পরীক্ষিত বন্ধু। খু’নিরা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হ’ত্যার দিনটিও বেছে নিয়েছিল, ভারতের স্বাধীনতা দিবস ১৫ আগস্টকে। বঙ্গবন্ধুকে হ’ত্যার পর খু’নিরা বাংলাদেশ বেতার দ’খল করে প্রথমে ঘোষণা করেছিল ইসলামী প্রজাতন্ত্র বাংলাদেশ। বেতারের নাম পরিবর্তন করে রেডিও বাংলাদেশ নাম দেয়া হয়। এ থেকেই বোঝা যায় খু’নি কারা।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সকালে ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর স’ঙ্গে আরও শাহাদতবরণ করেন মহীয়সী না’রী বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুননেছা মুজিব, বঙ্গবন্ধুর ছোটভাই শেখ নাসের, বীর মুক্তিযোদ্ধা শেখ কামাল, শেখ জামাল, তাদের পতœীদ্বয় সুলতানা কামাল, রোজী জামাল ও শি’শু শেখ রাসেলসহ আরও অনেকে। একই সকালে শহীদ হন যুবলীগ নেতা শেখ ফজলুল হক মণি, তার স্ত্রী আরজু মণি, আবদুর রব সেরনিয়াবাতসহ অনেকে।
সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কি শুধু আমাদের অবিসংবাদিত নেতা? তিনি মানবজাতিরও অবিসংবাদিত নেতা। তিনি মানবজাতির পথপ্রদর্শক। তার হ’ত্যাকারীদের বিচার হয়েছে। কয়েকজনের দন্ড কার্যকর হয়েছে। বাকিদের বিদেশ থেকে এনে দন্ড কার্যকর করার সক্রিয় প্রচেষ্টা চলছে। তবে, বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হ’ত্যা করে যে কলঙ্ক জাতির ললাটে লেপন করা হয়েছে, তা কি মুছে গেছে? এ কলঙ্ক অমোচনীয়।
হ’ত্যাকারীদের বিচার হওয়ায় কিছুটা স্বস্তি লাভ করা গেছে, এই যা। এ কলঙ্ক কোনোদিন মোচন হওয়ার নয়। বহুদিন ধরে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছে, বঙ্গবন্ধু হ’ত্যার পূর্বাপর পরিস্থিতি অনুসন্ধান ও বিশ্লেষণের জন্য একটি কমিশন গঠন প্রয়োজন। আত্মস্বীকৃত খু’নিরা তো আছেই। আর কারা কারা কীভাবে হ’ত্যায় জ’ড়িত ছিল তা জাতি জানতে চায়। আজ গোটা জাতির দাবি একটি কমিশন গঠনের।
বঙ্গবন্ধুর হৃদয়বিদারক মৃ’ত্যুসংবাদ শুনে বিশিষ্ট গুণীজন, সাহিত্যিক অন্নদাশংকর রায় লিখেছেন, ‘সংবাদটা শুনে দারুণভাবে ম’র্মাহত হই। আমার বন্ধুরাও এ খবরে ভে’ঙে পড়েন, নিদারুণ ক’ষ্ট পান। মনে হয়, তাদের ডেকে বলি আসুন বসে কাঁদি।’ তিনি বলেছেন, ‘গোটা বঙ্গোপসাগরের জল দিয়ে এ র’ক্ত মুছে সাফ করা যাবে না। বরং র’ক্ত লেগে রাঙা হবে বঙ্গোপসাগরের নীল জল। কাঁদো প্রিয় দেশ। তোমার চোখে যত জল আছে সব জল ঢেলে প্রক্ষালন করো এ র’ক্তাক্ত হাত।’
বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে অন্নদাশংকর রায় লিখেছেন,
যতকাল রবে পদ্মা যমুনা গৌরী মেঘনা বহমান
ততকাল রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান
দিকে দিকে আজ অশ্রুমালা র’ক্তগঙ্গা বহমান
তবু নাই ভ’য় হবে হবে জয় জয় মুজিবুর রহমান।
১৫ আগস্ট হ’ত্যাকান্ডের পর খু’নি মেজর বজলুল হুদা মেজর সাখাওয়াত হোসেনকে ফোন করে। সাখাওয়াত হোসেন পরে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হিসেবে অবসর নেন। পরে তিনি নির্বাচন কমিশনারও ছিলেন। তাকে ৩২ নম্বরে গিয়ে ছবির কিছু ফিল্ম নিয়ে আসার জন্য বলা হয়। কিছু পত্রিকা ও বিটিভি’র সাংবাদিকরা ওইসব ছবি তুলেছিলেন। তাদের ফিল্ম নিতে দেয়া হয়নি। সেগুলো এনে আ’র্মির সদর দফতরে জমা দিতে বলা হয়।
সাখাওয়াত হোসেন ওই সময় ৪৬ ব্রিগেড কমান্ডার, কর্ণেল শাফায়াত জামিলের স্টাফ অফিসার ছিলেন। তিনি কমান্ডারের অনুমতি নিয়ে ৩২ নম্বরে যান। তিনি তার বই ‘বাংলাদেশ : র’ক্তাক্ত অধ্যায়’-এ বলেছেন, ‘তারই বাড়ির দোতলায় সিঁড়ির মধ্য ধাপে নিষ্প্রা’ণ সুঠাম’দে’হী বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির বু’লেটবিদ্ধ মৃ’তদে’হ, গায়ে সাদা পাঞ্জাবি, পরনে চেক লুঙ্গি, ডানহাত বুকের ও’পর, বা হাত ঈষৎ এলানো। কিছু দূরে ছিটকে পড়া তার ব্যবহৃত চশমা। বুক ঝাঁজরা হয়ে গেছে গু’লির আ’ঘাতে। মুখমন্ডল তেমনি শান্ত। কোথাও কোনো ভ’য়ের চিহ্ন নেই। দেখে মনে হল মৃ’ত্যুর ছায়াও তার মুখে পড়েনি। তার চেহারার অভিব্যক্তিকে মনে হল তিনি তারই পরিচিত কাউকে সামনে দেখেছিলেন, যাকে দেখে হয়তো তিনি বিশ্বাসও করতে পারেননি এদের হাতেই তাকে বরণ করতে হবে এক অবিশ্বাস্য রকম মৃ’ত্যু। স্বাধীন বাংলাদেশের বাঙালি সৈনিকদের গু’লির আ’ঘাতে তার জীবনের ইতি হবে- এ কথা বিশ্বাস করা তো দূরের কথা, কল্পনাও করেননি।’
সাখাওয়াত হোসেন সাংবাদিক মাসকারেনহাসের ‘Bangladesh : A legacy of blood’ বই থেকে উদ্ধৃত করে বলেছেন, মেজর হুদা, মহিউদ্দিন ও নূর বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে প্রবেশ করে। স্টেনগান হাতে মেজর মহিউদ্দিন উপরে ওঠার সময় বঙ্গবন্ধু নামছিলেন। বঙ্গবন্ধুর বিশাল ব্যক্তিত্বের সামনে মেজর মহিউদ্দিন ভড়কে যায়। তোতলানো কণ্ঠে বলে, স্যার আপনি আসুন। তোমরা কী চাও? আমাকে মা’রতে এসেছো? তখনও মহিউদ্দিন তোতলানো কণ্ঠে কম্পিত অবস্থায় বলে, স্যার আপনি আসুন। বঙ্গবন্ধু কথা বলে সময়ক্ষেপণ করছিলেন এ ভরসায় যে, যাদের ফোন করেছেন, তারা নিশ্চয়ই সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসবে।
এ সময় মেজর নূর ক্ষিপ্রগতিতে এসে স্টেনগান দিয়ে বঙ্গবন্ধুর বুক গু’লিতে ঝাঁজরা করে দেয়। সাখাওয়াত হোসেন বলেছেন, ‘আমি বঙ্গবন্ধুর মৃ’তদে’হের সামনে বেশিক্ষণ দাঁড়াতে পারলাম না। তার শয়নকক্ষে চলে গেলাম। অতি সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের শয়নকক্ষ। তাতে একটি ডাবল খাট, পাশে একটি আলমারি। তারপর খুব একটা বেশি ফাঁকা জায়গা ছিল না। কোণায় একটি টেবিলের ও’পর রাখা গোটা তিনেক ফোন। লাল ফোনসহ। সাইড টেবিলে আরও কয়েকটি পাইপ টোব্যাকো। বেডরুমেই পরিবারের সব মৃ’তদে’হ। হয়তো একই রুমে সবাইকে হ’ত্যা করা হয়েছে। অথবা দু-একজনের মৃ’তদে’হ এখানে আনা হয়েছে।’
একজন তরুণ সে’না কর্মকর্তার বর্ণনায় আমরা দেখি, একজন বিশ্বনেতা, দেশের রাষ্ট্রপতি, বিশ্বের অন্যতম জনপ্রিয় নেতা কত সাধারণ জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছিলেন! কল্পনাও করা যায় না। বঙ্গবন্ধু পরিবারের এ বিলাসিতাহীন সাধারণ জীবনযাপনে সবচেয়ে বেশি যিনি প্রভাব বিস্তার করেছেন, তিনি হলেন বঙ্গবন্ধুর জীবনসাথী মহীয়সী না’রী বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুননেছা মুজিব।
বঙ্গবন্ধু দুপুরে গণভবনের খাবার খেতেন না। ৩২ নম্বর থেকে তার খাবার পাঠানো হতো। বঙ্গবন্ধু খেতেন যে কোনো ধরনের একটি শাক, মাছ অথবা মুরগির ঝোল। খেতেন খুবই অল্প। বঙ্গবন্ধুর বাপ-দাদারা বনেদি বিত্তবান ছিলেন; কিন্তু নিজেদের আরাম-আয়েশের জন্য সে বিত্ত ব্যয় করেননি। মানুষের কল্যাণে, মানুষের জন্যই ব্যয় করেছেন, দান করেছেন। আজও তার সুযোগ্য কন্যা ও পরিবারের সদস্যদের দিকে তাকালে দেখি কত সাধারণ জীবনযাপন করেন তারা।
বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠ কন্যা শেখ রেহা’না খুব ছোট্ট থাকতে একবার বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলেন, পলিটিক্স করো কেন? জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, তুই এমন কথা বলিস কেন? আমার কাছে তুইও যা, সাড়ে ৭ কোটি মানুষও তা।
আবুল কালাম আজাদ : প্রধান সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক, বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বাসস); সাবেক সভাপতি, বিএফইউজে।