এরশাদ অ্যান্ড ব্রাদার্সের চেয়ারম্যান এরশাদ আলী এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমিনুল ইসলামের বি’রুদ্ধে জালিয়াতি ও প্র’তারণা করে শত শত কোটি টাকার মালিক বনে যাওয়ার চাঞ্চল্যকর ত’থ্য পাওয়া গেছে।
এরশাদ ও আমিনুলের শত শত কোটি টাকার মালিক বনে যাওয়ার ঘ’টনা রূপকথাকেও হার মানায়। এরশাদ এসএসসি পাস করলেও আমিনুল প্রাইমারি স্কুলের গণ্ডি পার হতে পারেননি। একসময় যাঁদের দুই বেলা ভাত জুটত না, রিকশার গ্যারেজে রাত কাটত, সেই আমিনুল এবং তাঁর বড় ভাই এরশাদ আলী জোত-জালিয়াতি করে বর্তমানে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। হয়েছেন অন্তত ৫০০ কোটি টাকার মালিক।
রাজশাহীর ধূর্ত প্র’তারক আমিনুল ঢাকায়ও জালিয়াতির হোতা হিসেবে পরিচিত। কৌশলে ব্যবসার কথা বলে সাধারণ মানুষের টাকা মে’রে, ব্যবসায়ীদের পথে বসিয়ে এখন তাঁরা বিলাসী জীবন যাপন করছেন। ঢাকার ধানমণ্ডিতে পরিবার নিয়ে বসবাসের পাশাপাশি বিদেশেও পা’চার করেছেন কয়েক শ কোটি টাকা। জালিয়াতি করে ব্যবসায়ীদের টাকা আত্মসাতের অভিযোগে আমিনুল কা’রাগারেও ছিলেন। আর ভুয়া কাগজপত্রের মাধ্যমে চারটি ব্যাংকের ২৫০ কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া এবং বিদেশে পা’চারের অভিযোগে আমিনুলের ভাই এরশাদ আলীর বি’রুদ্ধেও মা’মলা রয়েছে।
কালের কণ্ঠ’র অনুসন্ধানে জানা গেছে, এরশাদ অ্যান্ড ব্রাদার্স করপোরেশনের চেয়ারম্যান এরশাদ আলী ও তাঁর ভাই আমিনুল ইসলামের অফিস বাংলামোটরের নাসির ট্রেড সেন্টারের লেভেল ৪-এ। আর এরশাদ ও আমিনুল পরিবার নিয়ে বসবাস করেন ধানমণ্ডির ৭/এ নিজস্ব বাসায়। রাজশাহী নগরীর বোয়ালিয়া থানার সাধুর মোড়ে রয়েছে তাঁদের বিলাসবহুল বাড়ি। এরশাদ ব্রাদার্স করপোরেশনসহ নানা নামে রাজশাহীর ভদ্রা, নওদাপাড়া আম চত্বর এলাকায় একাধিক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছে জালিয়াতির হোতা আমিনুল গং।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ১৯৮০ সালের শুরুর দিকে রাজশাহীর বাঘা উপজে’লায় পদ্মা নদীর ভাঙনকবলিত চর নারায়ণপুরের আব্দুর রশিদ ছেলে আমিনুল ও এরশাদ আলীসহ পরিবারের সবাইকে নিয়ে চলে আসেন রাজশাহী শহরে। শহরের ভদ্রা এলাকার আব্দুস সাত্তারের বাড়ির দুটি কক্ষে আব্দুর রশিদ পরিবারের সবাইকে নিয়ে থাকতেন। অভাবের তাড়নায় বাদাম বিক্রি এবং রিকশা চা’লিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতেন তাঁরা। আমিনুল নিজেও রিকশা চালাতেন, কখনো বাদাম বিক্রি করতেন। জালিয়াতি করে আমিনুল ও এরশাদ এখন শত শত কোটি টাকার মালিক।
ভদ্রা এলাকার স্থানীয় বাসিন্দা হযরত আলী হতবাক হয়ে পড়েন আমিনুলদের উত্থানের কথা বলতে গিয়ে। রাজশাহী শহরে ৩০ বিঘা জমির মালিক এখন আমিনুল আর এরশাদ। সাধুর মোড়ের বাসিন্দা আজিজার রহমান বলেন, প্র’তারণা করে, মানুষ ঠকিয়ে কিভাবে শতকোটি টাকার মালিক হওয়া যায় তার নমুনা আমিনুল আর এরশাদ।
অনুসন্ধানে জানা যায়, এরশাদ আলী শ্বশুরবাড়ির সহযোগিতায় মালয়েশিয়ায় গিয়ে আমিনুল ইসলামসহ অন্য ভাইদের নিয়ে যান। মালয়েশিয়া গিয়ে তাঁরা শুরু করেন মানুষ ঠকানোর ব্যবসা। বিদেশে লোক পাঠানোর নামে শত শত মানুষের স’ঙ্গে প্র’তারণা করে বনে যান কোটি টাকার মালিক। এরপর বাংলাদেশে ফিরে আমিনুল ও এরশাদ শুরু করেন হার্ডওয়্যারের ব্যবসা।
সেই ব্যবসার ফাঁকে বড় ভাই এরশাদ আলীর নামে এরশাদ অ্যান্ড ব্রাদার্স নামে একটি কম্পানি খোলেন। কম্পানির চেয়ারম্যান হন এরশাদ আলী আর ব্যবস্থাপনা পরিচালক হন আমিনুল ইসলাম। রাজধানীতে অফিস ভাড়া নিয়ে জৌলুসপূর্ণ সাজসজ্জা করে মো’টা অঙ্কের জালিয়াতির পরিকল্পনা করেন। ইট-পাথর, বালুর ব্যবসা করতে গিয়ে কয়েক শ মানুষের স’ঙ্গে প্র’তারণা করে আমিনুল হাতিয়ে নেন কোটি কোটি টাকা।
জালিয়াতির আশ্রয়ে কয়েকজন ব্যাংক কর্মকর্তার স’ঙ্গে যোগসাজশে হাতিয়ে নেন ২৫০ কোটি টাকা। ব্যাংক থেকে ঋ’ণ নিয়ে বিদেশে পা’চারসহ ঢাকা, রাজশাহী, গাজীপুর, সাভারে প্লট, ফ্ল্যাট, বাড়ি, শত শত একর জমি কেনেন আমিনুল ও এরশাদ আলী। ঋ’ণ জালিয়াতি ও প্র’তারণার অভিযোগে দু’র্নীতি দ’মন কমিশনসহ (দুদক) ঢাকা ও চট্টগ্রামে আমিনুল ও এরশাদের বি’রুদ্ধে রয়েছে একাধিক মা’মলা।
অনুসন্ধানে আরো জানা যায়, এরশাদ অ্যান্ড ব্রাদার্স করপোরেশন নাম দিয়ে কম মূ’ল্যে জমি কিনে বেশি মূ’ল্য দেখিয়ে প্র’তারণা করে একের পর এক ব্যাংকঋ’ণ নিতে থাকেন তাঁরা। রাজশাহী সিটি বাইপাসের পাশে কয়েক দিন আগেও অন্তত আটটি স্থানে ‘এই জমির মালিক এরশাদ অ্যান্ড ব্রাদার্স করপোরেশন’ নামে সাইনবোর্ড ঝোলানো ছিল। সম্প্রতি সাইনবোর্ডগুলো সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। তবে এখনো রাজশাহী নগরীর খড়খড়ি এলাকায় একটি সাইনবোর্ড রয়েছে।
স্থানীয় মুনসুর রহমান বলেন, ‘খড়খড়ি এলাকায় বাইপাসের পাশে অন্তত ৩০ বিঘা জমি কিনেছে এরশাদ এবং তার ভাইয়েরা। বিঘাপ্রতি ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকায় জমি কিনে সেই জমি বিঘাপ্রতি অন্তত কোটি টাকা মূ’ল্য দেখিয়ে ব্যাংক থেকে ঋ’ণ নিয়েছে তারা। কয়েক দিন ধরে সাইনবোর্ডগুলো আর দেখা যাচ্ছে না।’
জানা গেছে, দুদকের অনুসন্ধান শুরুর পর ওই সব সাইনবোর্ড সরিয়ে নেয় আমিনুল-এরশাদ গং। এদিকে দুদকের অনুসন্ধানেও উঠে এসেছে আমিনুল ও এরশাদ গংয়ের অ’বৈধ সম্পদের অনেক ত’থ্য। রাজশাহী নগরীর ভদ্রায়, রানীনগরে, সাধুর মোড় এলাকায়, পদ্মা আবাসিক এলাকাসহ বিভিন্ন স্থানে আমিনুল ও তাঁর ভাইদের নামে-বেনামে কয়েক শ কোটি টাকার সম্পদ রয়েছে। ঢাকার ধানমণ্ডি, উত্তরা, রাজশাহী শহরসহ বিভিন্ন স্থানে রয়েছে বিলাসবহুল বাড়ি। চলাফেরা করেন কোটি টাকা দামের গাড়িতে। রাজশাহীতে নতুন আরো একটি বহুতল ভবনের নির্মাণকাজ চলছে।
বিদেশে কর্মী পাঠানোর নামে প্র’তারণায় বে’পরোয়া হয়ে ওঠেন তাঁরা। পাথর, বালু, ইট সরবরাহের নামে শতাধিক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে জালিয়াতি করে আমিনুল হাতিয়ে নিয়েছেন অন্তত ৫০ কোটি টাকা। এসব জালিয়াতির পাশাপাশি আরো বড় জালিয়াতি করতে আমিনুল নিজে গ্যারান্টার হয়ে বড় ভাই এরশাদ আলীর নামে এবি ব্যাংকসহ কয়েকটি ব্যাংক ও একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে হাতিয়ে নেন ২৫০ কোটি টাকা।
জানা গেছে, ব্যাংকঋ’ণের এসব টাকার বেশির ভাগ বিদেশে পা’চার করা হয়েছে। এরশাদ অ্যান্ড ব্রাদার্স করপোরেশনের নামে এবি ব্যাংকের কাকরাইল শাখা থেকে ঋ’ণ নিয়েছেন ১৫০ কোটি টাকা। ব্র্যাক ব্যাংক থেকে নিয়েছেন ১৫ কোটি পাঁচ লাখ টাকা, সাউথইস্ট ব্যাংক থেকে নিয়েছেন ছয় কোটি টাকা। এ ছাড়া আর্থিক প্রতিষ্ঠান ফনিক্স ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট থেকে নিয়েছেন আরো ২৯ কোটি টাকা ঋ’ণ।
এর বাইরে আরো দুটি ব্যাংকেও এরশাদ ও আমিনুলের নামে ঋ’ণ আছে বলে জানা গেছে। পাওনা টাকা না পেয়ে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন আ’দালতে এনআই অ্যাক্টে চারটি মা’মলা করেছে এবি ব্যাংক। এর মধ্যে একটি মা’মলায় গত বছরের ১৬ সেপ্টেম্বর গ্রে’প্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন আ’দালত। ১৭ সেপ্টেম্বর আরেকটি মা’মলায় এরশাদের জা’মিন বাতিল করা হয়। গ্রে’প্তারি পরোয়ানা থাকায় তাঁকে আ’টকের চেষ্টা করছে ধানমণ্ডি থানা পু’লিশ। পাশাপাশি দু’র্নীতি দ’মন কমিশনও আমিনুল ইসলাম ও এরশাদের দু’র্নীতি-জালিয়াতির অভিযোগে অনুসন্ধান করছে।
ঢাকা ও রাজশাহীতে ধূর্ত প্র’তারক হিসেবেই পরিচিত আমিনুল ও এরশাদ। মানবপা’চার থেকে শুরু করে যখন যে সুযোগ পেয়েছেন, জালিয়াতি করে হাতিয়ে নিয়েছেন কোটি কোটি টাকা। সর্বশেষ ২০১৮ সালে রাজধানীর বনানীর এসএইচএল রিয়েল এস্টেট কম্পানি প্র’তারক আমিনুল ইসলামের স’ঙ্গে যৌথভাবে ব্যবসা করতে গিয়ে প্র’তারণার শি’কার হয়।
এসএইচএল কম্পানির স’ঙ্গে ৪০ ভাগ শেয়ারে ব্যবসার চুক্তি হয়। চুক্তি অনুযায়ী সিমেন্ট, পাথরসহ অন্যান্য উপকরণ সরবরাহ করার কথা আমিনুলের। কিন্তু তিনি কোনো অর্থ বিনিয়োগ না করে উল্টো ইট, বালু, সিমেন্ট, পাথর কেনার টাকা ওই কম্পানির কাছ থেকে নিয়ে পাথর, সিমেন্ট, বালু ব্যবসায়ীদের টাকা পরিশোধ না করে আত্মসা’ৎ করেন আমিনুল।
এসএইচএল কম্পানির পরিচালক আমির হোসেন ক্ষো’ভ প্রকাশ করে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমিনুল একজন ভ’য়ংকর প্র’তারক। প্র’তারণা করে আমাদের সাত কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।
রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানের শতাধিক মানুষ আমিনুলের কাছে কোটি কোটি টাকা পায়। এর আগে চট্টগ্রামের এক ব্যবসায়ীর আট কোটি টাকা প্র’তারণা করে হাতিয়ে নেওয়ায় জে’লও খাটে আমিনুল। পাওনা টাকা আদায়ে তার বি’রুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে আমরাও প্রক্রিয়া শুরু করেছি।’